লিটন চৌধুরী রৌমারী (কুড়িগ্রাম) প্রতিনিধি ঃ
কুড়িগ্রামের রৌমারীতে ভিজিডির নতুন নামে চালু হওয়া ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (ভিডব্লিউবি ‘র)প্রকল্পের তালিকা তৈরিতে ব্যাপক
অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তিতে নেওয়া হয়েছে ৫ থেকে ৮ হাজার করে টাকা। এতে প্রায়
দুই কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন সংঘবদ্ধ চক্র। এমন কান্ডে সরকারের মহতি এ প্রকল্পটির সুফল থেকে হতদরিদ্ররা বঞ্চিত হচ্ছেন বলে দাবি
এলাকার সচেতন মহলের।
রৌমারী উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত ভিডব্লিউবি’র ২০২৩-২০২৪ চক্রের আওতায় উপজেলার ৬টি ইউনিয়নে মোট ৩ হাজার ২৫৩ টি কার্ড বরাদ্দ হয়। এর বিপরীতে অনলাইনে আবেদন পড়ে মোট ১২ হাজার ৪০০টি নীতিমালায় বলা আছে,
ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের সভাপতিত্বে, তৃণমূল পর্যায়ে কমিটির মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে উপকারভোগিদের তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। পরে ইউনিয়ন কমিটি সকল তালিকা সমন্বয় করে উপজেলা কমিটিতে জমা দেবেন। অসচ্ছল,বিধবা,তালাকপ্রাপ্ত নারী ও প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকারের কথাও বলা আছে এই নীতিমালায়। তবে এ নীতিমালার কোন তোয়াক্কা না করেই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি,সরকার দলীয় নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ভিডব্লিউবি কার্ডের নাম ভাগাভাগি করে নেওয়ার ঘটনা ঘটে।
এর মধ্যে উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ৬%, দুই
ভাইস চেয়ারম্যন ৬%, প্রতিমন্ত্রী, মুক্তিযোদ্ধা, দল (আওয়ামী লীগ) মিলে ২৩% ও ৬ ইউনিয়নে ৬৫% ভাগভাগি করে নেন। ভাগাভাগির পর চলে কার্ড
বিক্রির প্রতিযোগিতা। প্রতি কার্ড বিক্রি হয় ৫ থেকে ৮ হাজার টাকায়। এ নিয়ে গোটা উপজেলায় বইছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।অন্যদিকে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা ইচ্ছে মাফিক সদস্যদের মাঝে ভাগ করে দেন এসব কার্ড। কাগুজে ক্ষমতা দিলেও বাস্তবে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে বলে অভিযোগ সংরক্ষিত সদস্যেদের। এমন অবস্থায় তালিকা থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ অসচ্ছল, বিধবা, প্রতিবন্ধীসহ হতদরিদ্রদের।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, টাকার অভাব ও প্রচারের ঘাটতিতে হতদরিদ্রদের অনেকেই অনলাইনে আবেদন করতে পারেননি। অপরদিকে যারা আবেদন করেন তাঁদেরকে বাছাইয়ের জন্য কোথাও ডাকা হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি কার্ডে নেওয়া হয়েছে ৫ থেকে ৮ হাজার করে টাকা।
রৌমারী সদর ইউনিয়নের মন্ডলপাড়া গ্রামের কর্মক্ষমহীন মোতালেবের স্ত্রী মাকছুদা খাতুন বলেন, স্বামি অসুস্থ্য। ৩ ছেলে ও ২ মেয়েকে নিয়ে খুব
কষ্টে আছি। মেম্বার-চেয়ারম্যান ও নেতাদের কাছে গিয়েছিলাম একটি কার্ডের জন্য। টাকা ছাড়া কার্ড হবে না বলে ফেরত দিয়েছেন তাঁরা।
শৌলমারী ইউনিয়নের বেহুলারচর গ্রামের আব্দুল গফুরের বিধবা মেয়ে মমিরন নেছা অভিযোগ করে বলেন, সহায়- সম্বলহীন স্বামী মারা যাওয়ার পর
দুই সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে ঠাই নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন তিনি। সরকার তাঁদের মতো অসহায়দের জন্য হাজার হাজার নাম
বরাদ্দ দিলেও চেয়ারম্যান-মেম্বাররা সেগুলো টাকার বিনিময়ে সচ্ছল ও ধনী শ্রেণির মানুষের কাছে বিক্রি করছেন।
দাঁতভাঙ্গা ইউনিয়নের বালুরগ্রামের প্রতিবন্ধী সাদিকু ল ইসলামের স্ত্রী হাছনা বানুর অভিযোগ আরও গুরুতর। তিনি বলেন,তাঁর স্বামী একজন প্রতিবন্ধী মানুষ। আয় রোজগার নাই। খেয়ে না খেয়ে সন্তানদের নিয়ে দিনাতিপাত করছেন তাঁরা। তাই ভিজিডি ( ভিডব্লিউবি’র ) কার্ডের জন্য দ্বারে দ্বারে গেছেন। কেউ পাত্তা দেননি। তাঁর কাছে সরাসরি না হলেও অন্যের মাধ্যমে টাকা চাওয়া হয়েছে। টাকা দিতে পারেননি বলে তালিকায় তাঁর নাম ওঠেনি।
বন্দবেড় ইউনিয়নের সংরক্ষিত ১নম্বর ওয়ার্ড সদস্য রুবি খাতুন অভিযোগ করে বলেন,
নীতিমালা অনুযায়ি ভাগ চাইতে গেলে ইউপি
চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের তাঁকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই বলেও জানান ওই চেয়ারম্যান।’ তিনি আরও বলেন,
নীতিমালা অনুযায়ি ১০০নাম তালিকা করার এখতিয়ার থাকলেও তাঁকে দেওয়া হয় ২০টি নাম তালিকা করার ক্ষমতা।যাদুরচর ইউনিয়নের ২নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত সদস্য রহিতন নেছাবলেন,‘ভাগে ২০টি নাম পেয়েছি। তা নিজের আত্মীয়-স্বজনদের নামে দেওয়া হয়েছে। তবে টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করেন ওই ইউপি সদস্য।
বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার শামছুল আলমের ভাষ্য, যাদের ঘরে খাবার আছে,‘টাকা দিতে পারছেন তাঁদেরকেই এসব নাম দেওয়া হচ্ছে।’তবে মুক্তি যোদ্ধাদের নামে কোনো কার্ড বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কিনা সেটা তাঁর জানা নেই।রৌমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হোরায়রা বলেন, ৪২২টি নাম ভাগে পাওয়া গেছে। তা দলের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।
বন্দবেড় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের বলেন, সংরক্ষিত সদস্যরা ভিডব্লিউবি’ তালিকা যাচাই-বাছাই কমিটির প্রধান হবেন এমন
নিয়ম নেই। জনসংখ্যার অনুপাতে নাম ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।টাকা নেওয়ার কথা অস্বীকার করে রৌমারী সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, যারা নাম পাননি তাঁরাই এমন অভিযোগ করছেন।ইউনিয়নে যে নাম ভাগে পাওয়া গেছে, তা আমরা ১৩জন সদস্য মিলে ভাগাভাগি করে নিয়েছি।রৌমারী উপজেলা আওয়া মী কৃষক লীগের সভাপতি মতিয়ার রহমান চিশতী আক্ষেপ করে বলেন, ভিডব্লিউবি’র নাম দিতে টাকা নেওয়ার বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যাচাই-বাছাই ছাড়া টাকাতে যদি নাম হয় তাহলে অনলাইনে আবেদনের নামে গরীবের সাথে তামাশা করা হলো কেনো?
রৌমারী প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক জিতেন চন্দ্র দাস অভিযোগ করে বলেন,প্রেসক্লাবের নাম ভাঙিয়ে একটি চক্র ভিডব্লিউবি’র কার্ড ভাগভাগি করে নিয়ে ছেন। সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান তিনি। ভিডব্লিউবি
প্রকল্পের সদস্য সচিব ও রৌমারী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা জেবুন নেছা বলেন, ভাগাভাগির বিষয়টি তাঁর জানা নেই।
তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ি নামের তালিকা করা হয়েছে। তালিকা যাচাই-বাছাই সঠিকভাবে মনিটরিং করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জনবল সঙ্কটের কারণে এতো নাম মনিটরিং করা সম্ভব হয়নি। টাকা নেওয়ার বিষয়ে লিখিত অভিযো গ পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস।