সবুজ হোসেন রাজা সিরাজগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি , :
বাংলা সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত শাহজাদপুর কাছারি বাড়ী। রবীন্দ্র জীবনে ও সাহিত্য ভুবনে সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর এক অ বিস্মরণীয় নাম। বিশ্বকবির শৈশব ও যৌবনের নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে শাহজাদপুর কাছারি বাড়ীকে ঘিরে।শাহজাদ পুরের উন্মুক্ত উদার দ্বারে এসে নিখিল বিশ্বের সামনে কবি প্রাণের গভীর বন্ধন স‚চিত হয়। তাঁর চিত্তে ও কর্মবোধের সর্বোচ্চ সমন্বয় ঘটেছিলো শাহজাদপুরে এসেই যা তিনি স্বীকার করেছেন লেখনীর মাধ্যমেই।
শাহজাদপুরের কাছারিবাড়ি রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত একটি ঐতিহাসিক স্থান ও পর্যটন কেন্দ্র। আর তাই প্রতি দিন দেশ-বিদেশ থেকে রবীন্দ্র কাছারি বাড়ীতে আগমন ঘটে পর্যটকদের।ডিহি শাহজাদপুর জমিদারি একদা নাটো রের রাণী ভবানীর জমিদারীর অংশ ছিলো। ১৮৪০ সালে শাহজাদপুরের জমিদারি নিলামে উঠলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরে র পিতামহ প্রিন্স দারকনাথ মাত্র ১৩ টাকা দশ আনায়কিনে নেন। জমিদারির সাথে সাথে শাহজাদপুরের কাছারি বাড়ি ঠাকুর পরিবারের হস্তগত হয়েছিলো বলে ধারনা করা হয়। তার আগে এখানে ছিল নীলকরদের নীলকুঠি।তবে নীলকু ঠি বর্তমান পরিত্যাক্ত।
লন্ডন থেকে ঘুরে আসার পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ওপর জ মিদারি তদারকির ভার ন্যস্ত হয়। ১৮৯০ সাল থেকে ১৮৯ ৭ সাল পর্যন্ত মাত্র আট বছর জমিদারি দেখাশোনার জন্য মাঝে মাঝে শাহজাদপুরে আসতেন এবং সাময়িক ভাবে বসবাস করতেন।এখানে অবস্থানকালে কবিগুরু রচনা করেন:- কাব্য: সোনারতরী,বৈষ্ণব কবিতা,দুটি পাখি,আকা শের চাঁদ,পুরস্কার,যমুনা,হৃদয়,ভরা ভাদরে,প্রত্যাখ্যান ও লজ্জা। চিত্রা : চিত্রা, শীত ও বসন্তে, নগর সংগীত।
চৈতালী : নদীযাত্রা, মৃত্যুমাধুরী,স্মৃতি বিলয়,প্রথম চুম্বন,শেষ চুম্বন,যাত্রী,তৃণ,ঐশ্বর্য,স্বার্থ,প্রেয়সী,শান্তিময়,কালিদাসের প্র তি,কুমার,মানষলোক,কাব্যপ্রার্থনা,ইছামতী নদী,সুশ্রুসা,অ শিক্ষাগ্রহন,বিদায়। করুনা : নববিবাহ,রজ্জিতা,বিদায়,হত ভাগ্যের গান,গতোনিক,বঞ্চনা,সংকোচ,মানষ প্রতিভা, রাম কানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা,ব্যবধান,তারাপ্রসন্নের কীর্তি, ছুটি, সম্পত্তি,ক্ষুধিত পাষাণ,অতিথি ইত্যাদি। ছিন্ন পত্রাবলী : ৩৮ টি ছিন্ন পত্রাবলী। প্রবন্ধ : পঞ্চভ‚তের অংশবিশেষ। নাটক : বিসর্জন।
তিনি স্থায়ীভাবে থাকতেন কুষ্টিয়ার শিলাইদহে সম্ভবত এ কারনে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে তার বাসগৃহ কুঠিবাড়ী ও শাহ জাদপুরের বাড়িটি কাছারি বাড়ি নামে পরিচিত।সিরাজ গঞ্জের শাহজাদপুরে পৌর সদর দ্বারিয়াপুরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি। শাহজাদপুরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তার মানস গঠনে ও এ অঞ্চলের প্রভাব অনস্বীকার্য। ১৯৪০ সালে বাণী সম্মেলনীতে তিনি সে কথা স্বহস্তে লিখে পাঠান।
১৯৬৯ সালে শাহজাদপুরের এই কাছারি বাড়ীকে পরিছন্ন করে সরকার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় এনে সংরক্ষ ণের উদ্যোগ নেয় এবং ১৯৯৯ সালে কাছাড়ি বাড়ীর পশ্চি ম আঙ্গিনায় ৫০০ আসন বিশিষ্ট উত্তর বঙ্গের সবচেয়ে না ন্দনিক অডিটোরিয়াম নির্মান করে। প্রতি বছর বাংলা সনে র ২৫, ২৬, ২৭ বৈশাখ কবির জন্মজয়ন্তী সরকারিভাবে উদযাপন করা হয় নানা অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে। উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে এ উপলক্ষে ৫দিন ব্যাপী বসে রবীন্দ্র মেলা।
এসময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কবি ভক্তরা ভীড় করে কবির কাছারি বাড়ীতে। বর্তমানে কাছারি বাড়ীটি আধুনিক তায় বাহারী গাছ ও ফুলের সমারোহে সুসজ্জিত করারফলে পর্যটকদের দারুন ভাবে আকর্ষিত করছে।এক কথায় দর্শ নার্থীদের নজড় কারে বিশ্বকবির শাহজাদপুরের কাছারি বাড়ি।
বিশ্বকবির এই কাছারি বাড়িকে স্থানীয়রা রবীন্দ্র কাছারি বলে ডাকে।শাহজাদপুরের পৌর শহরের দ্বাড়িয়াপুরে কাপড়ের হাট সংলগ্ন উপজেলা পরিষদের উত্তরে প্রায় দশ বিঘা জমির ওপর পুরো কাছারি বাড়ির অবস্থান। রবীন্দ্র স্মৃতি যাদুঘর হলুদ রঙের দ্বি-তল ভবন। ভবনের দৈর্ঘ্য ২৬.৮৫ মিটার, প্রস্থ ১০.২০ মিটার, উচ্চতা ৮.৭৪ মিটার। প্রতি তলায় সাতটি করে ঘর। উত্তর ও দক্ষিণে প্রশস্থ বারা ন্দা। কুঠি-ভবনের পাশেই কাছারি বাড়ি, মালখানা পুরোটাই রবীন্দ্র কাছারি। কাছারি বাড়িটি দেখভালে একজন কাস্টো ডিয়ানসহ স্থায়ী অস্থায়ী ভিত্তিতে দশজন জনবল নিযুক্ত করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর।
কাছারি বাড়ির দক্ষিণ দিকের গেটটি বর্তমানে প্রধান গেইট করা হয়েছে। কাছারি বাড়ির গেটে দাঁড়ালেই চোখ জুড়িয়ে যায়, বড় বাগান নানা রঙের ফুল, বাগানের পরই তার হলুদ রঙের দোতলা কুঠি। নিচতলা জুড়ে রবীন্দ্রনাথের নিজের বিভিন্ন ছবি,তার আঁকা ছবি এবং তার হাতে লেখা পান্ডুলি পির পাতার অংশ বাধাই করে দেয়ালে টানানো রয়েছে। কিছুদিন আগেও এখানে লাইব্রেরি ছিল।অডিটোরিয়াম হও য়ার পর লাইব্রেরিটি তারই একটি কক্ষে স্থানান্তরিত হয়েছে উত্তরদিকের বারান্দার একেবারে পশ্চিমে সিঁড়িঘর।
গোল-প্যাঁচানো সিঁড়িটি যেন সবাইকেই উপরে উঠার জানা ন দেয় ওঠার সময় পশ্চিমে একটি জানালা। সিঁড়ির মুখেই দুটি দরজা একটি দরজা খোলা শুরুতেই একটি পালকি চোখে পরবে,এটিই সেই ঠাকুর বাড়ির পালকি।বংশ পরম্পরায় ব্যবহার হয়েছে এই পালকি,পড়ার টেবিল,চিঠি লেখার ডেস্ক,আলনা,গোল টি-টেবিল। এরপর এঘর থেকে সেঘর। সেগুলোতে রক্ষিত রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত নানারকম আসবাব-তৈজষপত্র বেতের চেয়ার,বড় ড্রেসিং টেবিল,চিনা মাটির ছাকুনি,টেবিল বেসিন,আলনা,দেবতার আসন,বড় টেবিল,শ্বেত পাথরের গোল টেবিল,ইজি চেয়ার,
পিয়ানো,কাঠের দোলনা চেয়ার,সোফা সেট,হাতলযুক্ত চে য়ার,স্ট্যান্ডে সংযুক্ত দুটি ড্রয়ার,হাতলওয়ালা গদিযুক্ত চেয়া র,আলনা স্ট্যান্ড,৫টি আলমারি,আলমারির ভেতরে কেতলি ,সসপ্যান,ফ্রাইপ্যান,কাটা চামচ,চিনা মাটির ফুলদা নি,ডিস ,টব,জগ,জমিদারি মনোগ্রাম ৭টি,বালতি,কেরোসিনের বাতি,ঘণ্টা ট্রে,বাতির চিমনি ইত্যাদি। আরও রয়েছে দুটি খাটপ্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী বেড়াতে আসেন এই কাছারি বাড়িতে। বর্তমানে শাহজাদপুরে কবির স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।