প্রথম বাংলা – ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে চলছে অনিয়ম,দুর্নীতি ও ঘুস-বাণিজ্য। ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও প্রতিষ্ঠান প্রধানের যোগসাজশে নিয়োগ পরীক্ষায় ফাঁকফোকরসহ নানা অনিয়মে সহযোগীর ভূমিকা পালন করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন। এছাড়া সভাপতি, প্রতিষ্ঠানপ্রধান ও শিক্ষা কর্মকর্তার পছন্দের প্রার্থীকে পাশ করানোর জন্য ডিজির প্রতিনিধিসহ প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক ও নিয়োগ বোর্ডকে ম্যানেজ করার মূল দায়িত্ব পালন করছেন মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা।
বিধিবহির্ভূত হলেও বেশিরভাগ নিয়োগ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় গোপনে মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় অথবা ময়মনসিংহের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। নিয়োগে সভাপতি ও শিক্ষা কর্মকর্তার পছন্দের ওইসব প্রার্থীকে কৌশলে পাশ করানোর সুবিধার্থে সেখানে বসেই তৈরি করা হয় প্রশ্নপত্র।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় একেএম মোশাররফ হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ের নিয়োগ বাতিলের দাবিতে ২০ ফেব্রুয়ারি মুক্তাগাছা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেন ভুক্তভোগী মুক্তা আক্তার, রত্না আক্তার, রবিন ইসলাম ও রুবেল মিয়া। তাদের দাবি, মুক্তাগাছা উপজেলার বাঁশাটি ইউনিয়নের একেএম মোশাররফ হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ে গত বছরের ২৩ অক্টোবর পাঁচটি পদে কর্মচারী নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক চাকরির জন্য আবেদন করেন তারা। সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক তাদের নামে কোনো প্রকার ইন্টারভিউ কার্ড ইস্যু না করে এবং কোনোকিছু না জানিয়ে অতি গোপনে নিয়োগ প্রাপ্তদের প্রতিজনের কাছ থেকে ১২ লাখ করে টাকা নিয়ে নিয়োগ প্রদান করেন।
এ বিষয়ে তারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় সংসদ-সদস্যকে বিষয়টি অবহিত করেছেন এবং নিয়োগ বাতিল করে পুনরায় নিয়োগের দাবি করেন তারা। এখানেই শেষ নয়, উপজেলার গড়বাজাইল উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক, সহকারী প্রধান শিক্ষক, অফিস সহকারী, নিরাপত্তাকর্মী ও আয়া এ পাঁচটি পদে নিয়োগে ৭০ লাখ টাকা ঘুস-বাণিজ্য হয়েছে। এছাড়া লক্ষীখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৩০ লাখ টাকা, ভিটিবাড়ী আলিম মাদ্রাসায় ৪৫ লাখ, বারব-রাবেয়া নগর আইটি স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৮০ লাখ, হাজী কাশেম আলী টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিএম কলেজে ৩০ লাখ, পদুরবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়সহ প্রায় ২০টি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে ১০ কোটি টাকার ঘুস-বাণিজ্য হয়েছে।
ওইসব নিয়োগে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ঘুস-বাণিজ্যে জড়িত থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ভাগাভাগির কোটি টাকা নিজের পকেটে ভরেছেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শাহাদাত হোসেন। উপজেলায় চলমান অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগে অনিয়ম ও ঘুস-বাণিজ্যে শিক্ষা কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা থাকায় তার নামে আদালতে একাধিক মামলা করেন ভুক্তভোগীরা, যা এখনো চলমান রয়েছে।
এছাড়া ভিটিবাড়ি আলিম মাদ্রাসায় নিয়োগে ঘুস-বাণিজ্য ও অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় শিক্ষা কর্মকর্তা শাহাদাত হোসনকে ২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জামালপুরের মাদারগঞ্জে বদলি করা হয়। এ খবর শুনে বিভিন্ন এলাকায় মিষ্টিও বিতরণ করেন এলাকাবাসী। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সে বদলিও আটকে যায়। গুঞ্জন রয়েছে, সাবেক সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীকে দিয়ে তদবির করিয়ে বদলি আটকান শিক্ষা কর্মকর্তা। বদলির পাঁচ মাস পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত বহাল তবিয়তে অফিস করছেন এবং নিয়োগ-বাণিজ্যে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন তিনি।
জানা যায়, গড়বাজইল উচ্চবিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষা ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বর খুব গোপনে ময়মনসিংহের ল্যাবরেটরি স্কুলের একটি শ্রেণিকক্ষে অনুষ্ঠিত হয়। পরের মাসের (১০ জানুয়ারি) নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এবং ২১ জানুয়ারি সভাপতি মূসা নিজে স্কুলে এসে নিয়োগ প্রাপ্তদের যোগদান করান। পরে ব্যাকডেটের ১০ জানুয়ারি তারা প্রতিষ্ঠানে যোগদান করেছেন মর্মে শিক্ষকদের দিয়ে নতুন খাতায় স্বাক্ষর করিয়ে নেন সভাপতি। এতে বিষয়টি সর্বমহলে জানাজানি হলে এলাকায় হট্টগল শুরু হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে নতুন নিয়োগ প্রাপ্তদের স্কুলে রেখেই পালিয়ে স্কুল ত্যাগ করেন সভাপতি মূসা।
এদিকে,গড়বাজইল উচ্চবিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য, অভিভাবক সদস্য ও শিক্ষক প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে বিদ্যালয়ে নিয়োগে সভাপতি ও প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) এবং শিক্ষা কর্মকর্তা মোটা অংকের টাকা ঘুস নিয়েছেন দাবি করে স্থানীয় সংসদ-সদস্য বরাবর একটি লিখত আবেদন করেন। আবেদনে বিদ্যালয়ের অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ বাতিল ও এমপিও বন্ধ করার দাবি করেন তারা। বিদ্যালয়ের সভাপতি আবু সালেহ মূসা বলেন, ‘তুমি (প্রতিবেদকে) কি নিউজ করবা এ বিষয়ে? যদি করো লিখে দাও এ বিষয়ে আমার (সভাপতি) কোনো বক্তব্য নেই।’ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুর রোউফ বিএসসি বলেন, ‘নিয়োগে অনিয়ম ও ঘুস-বাণিজ্য যা করার সভাপতি ও শিক্ষা শিক্ষা কর্মকর্তা করেছেন। সব কাজ তারাই করছেন, মাঝে মধ্যে তারা আমাকে যেখানে ডেকেছেন আমি গিয়ে কাজ করে দিয়ে এসেছি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ সিন্ডিকেটের মূল কারিগর শিক্ষা কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেনকে একাধিকবার ফোন করা হলে প্রতিবেদকের মোবাইল নম্বরটি ব্লাকলিস্টে রাখেন এবং সরাসরি সাক্ষাৎও দেননি তিনি। যে কারণে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। মুক্তাগাছার সংসদ-সদস্য কৃষিবিদ নজরুল ইসলাম জানান, অভিযোগের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নিতে ডিও লেটারের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করা হয়েছে।